লোক পরস্পরায় চলে আসছে ‘‘লাল দালান’’ কথাটা৷ চারপাশ ঘিরে ভারী উঁচু দেয়াল, মধ্যে লোহার গারদে আটক মানব সন্তান৷ তার দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা আমাদের গতিময় স্বাভাবিক জীবনকে স্পর্শ করে না৷ বন্ধ কুঠুরীতে আত্মদহনে জ্বলে-পুড়ে কেউ হয় খাঁটি সোনা, আঁধার মানিক, আবার কেউবা ডুবে যায় অন্ধকার অতলে৷ প্রশ্ন কি জাগেনা একই জগতের মধ্যে চার দেয়ালে ঘেরা রহস্যময় আলাদা জগৎ কিভাবে তৈরী হল? উল্লেখ্য, একদা এ জগতের সকল অবকাঠামো লাল রংয়ে মোড়া ছিল৷
কারাগার বা জেলখানার উৎপত্তির সঠিক নির্ঘন্ট পাওয়া খুবই দুরূহ ৷ ইতিহাসবেত্তাদের কাছে এ বিষয়টি এখনো উন্মোচনের অপেক্ষায়৷ কারা ব্যবস্থাপনার অতীত খুঁজে যেটুকু জানা যায়, ১৫৫২ সালে লন্ডনে একটি প্রাসাদ St Briget well প্রথম কারাগার হিসাবে চিহ্নিত হয়৷ রাষ্ট্রীয়, সামাজিক বিভিন্ন দিক থেকে কারাগারের উপযোগিতা উপলদ্ধি করে ১৫৯৭ সালে বৃটিশ সরকার এ ধরণের আরো কয়েকটি কারাগার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়৷ ১৬০০ সালে লন্ডনের প্রত্যেক কাউন্টিতে কারাগার তৈরীর নির্দেশ দেয়া হয়৷ প্রাথমিক পর্যায়ে এ কারাগার গুলোতে বন্দীদের দৈহিক পরিশ্রম ও নিয়মানুবর্তিতার দিকে দৃষ্টি দেয়া হত৷ তবে, অষ্টাদশ শতাদ্বীন্তে ইংল্যান্ডে Gaol বা জেলখানার ধারণা যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করে৷ কারণ সেই সময়ে এই ধরণের Gaol মৃত্যু কুঠুরী হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছিল৷ প্রায় আলো বাতাসহীন ঘরে নারী পুরুষ সবাইকে একত্রে রাখা হত৷ ফলে অনেক মহিলা নিগৃহিত হত৷ এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ সোচচার হয়ে উঠলে এ ব্যবস্থার আশু সংস্কার করা নহ৷ সে সময়ে কারা সংস্কারে দারুণ অবদান ছিল জন হাওয়ার্ড নামের একজন সামাজিক ব্যক্তিত্বের৷ তিনি দীর্ঘ কয়েক বছর (১৭৭৩ খ্রিঃ-১৭৯০খ্রিঃ) কারাগারসমূহ পরিদর্শন করে বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে অনেক লেখা-লেখির পর কারা ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়৷ ১৮১২ খ্রিঃ ইংল্যান্ডে প্রথম জাতীয় কারাগার Milk Bank প্রতিষ্ঠিত হয়৷ পঁচিশ লাখ পাউন্ড ব্যয়ে নির্মিত Milk Bank-এ তিন কিলোমিটার লম্বা বারান্দাসহ কয়েকশত প্রকোষ্ঠ ছিল, যার কাজ শুরু হয়েছিল ১৮১২ সালে এবং শেষ হয় ১৮২১ সালে৷
যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভের পর ১৭৯০ সালে ফিলাডেলফিয়া অঙ্গরাজ্যে Wal Nut St. Jail প্রথম রাষ্ট্রীয় কারাগার হিসেবে স্থাপিত হয় ৷ নিউইয়র্ক সিটিতে ১৭৯৬ সালে এবং মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে ১৮২৯ সালে কারাগার স্থাপিত হয় ৷ পরবর্তীতে মেরিল্যান্ডর কারাগারে বন্দীদের জন্য স্কুল সম্পৃক্ত করা হয়৷ ১৮৩২ সালে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে স্থাপিত কারাগারে প্রথমবারের মত পুরস্কার পদ্ধতি হিসাবে বন্দীদের ভাল আচরণের জন্য মাসে ০২(দুই) দিন জেল মওকুফ ও খারাপ আচরণের জন্য কয়েক ধরণের শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ ১৮৩১ সালে ভারমন্ট কারাগারে স্বজনদের সাথে পএ যোগাযোগের সুযোগ দেয়া হয় ৷
গবেষণার অভাবে দূর অতীতে আমাদের উপমহাদেশে কারাগার ও ব্যবস্থাপনার সুনিদির্ষ্ট তথ্যের যোগান সীমিত হয়ে আছে ৷ জানা যায়, ভারতের রাজা অশোকের সময়ে মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত বন্দীকে তিন দিন একটি কুঠুরীতে বেঁধে রাখা হতো ৷ এ ধরণের কয়েদ খানার অস্তিত্ব জমিদারী ব্যবস্থাপনায় ছিল ৷ উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আগমনের পর মূলতঃ কারা ব্যবস্থাপনা নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ পেতে থাকে ৷ ১৮১৮ সালে রাজবন্দীদের আটকার্থে বেঙ্গল বিধি জারী করা হয় ৷ বর্তমানের বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা এবং কয়েকটি জেলা ও মহকুমা কারাগার উক্ত সময়ে নির্মিত হয়৷ তবে ১৭৮৮ সালে একটি ক্রিমিনাল ওয়ার্ড নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা কারাগারের কাজ শুরু হয় ৷ ১৮৬৪ সালে সকল কারাগার পরিচালনা ব্যবস্থাপনার মধ্যে এক সমন্বিত কার্যক্রম প্রতিষ্ঠিত হয় Code of rules চালুর মাধ্যমে৷ ১৯২৭ সালের এপ্রিলে কিশোরদের জন্য বাকুড়ায়(ভারত) প্রথম Borstal Institute স্থাপিত হয়৷ ১৯২৯ সালে অবিভক্ত বাংলায় কোলকাতার প্রেসিডেন্সি, আলীপুর, মেদিনিপুর, ঢাকা ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে ঘোষিত হয়৷ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ০৪ টি কেন্দ্রীয় কারাগার, ১৩টি জেলা কারাগার এবং ৪৩ টি উপ-কারাগার নিয়ে বাংলাদেশ জেল (বি ডি জে) এর যাত্রা শুরু ৷ পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে বন্দী সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে উপ-কারাগার গুলিকে জেলা কারাগারে রূপান্তর করা হয় ৷ বর্তমানে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ৫৫টি জেলা কারাগার নিয়ে বাংলাদেশ জেল কাজ করে চলছে ৷